জেলার পটভূমি

সুদূর অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লালমনিরহাট অঞ্চলের প্রশাসনিক ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কারণ, যে সমস্ত এলাকা নিয়ে আজকের লালমনিরহাট জেলার ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত হয়েছে তা যুগে যুগে সামগ্রীক অথবা খন্ডিতভাবে বিভিন্ন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। যার প্রামাণ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা আজ আর মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তথাপি প্রাচীন তথ্য অবলম্বনে গবেষকগণের মূল্যবান দলিল থেকে সংক্ষেপে যতদূর জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রাচীন রাজ্যের নাম প্রাগজ্যোতিষপুর। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তবিংশতি শতাব্দীর দিকে প্রাগজ্যোতিষপুরে মহীরঙ্গ নামে একজন রাজা ছিলেন। অনার্য হওয়ায় তাকে দানব বলে অভিহিত করা হতো। তিনি ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপ রাজ্যের পরাক্রমশালী রাজা নরকের পূর্বপুরুষ। রাজা নরক এ অঞ্চল থেকে কিরাদ জাতির লোকজনদের বিতাড়িত করে স্বীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে সমগ্র অঞ্চল প্রাগজ্যোতিষপুরভূক্ত হয়। রাজা নরক অসুর বলে বিবেচিত হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক এক যুদ্ধে নিহত হন। অতঃপর শ্রীকৃষ্ণ রাজা নরকের পুত্র ভগদত্তকে প্রাগজ্যোতিষপুরের সিংহাসন দান করেন। ভগদত্ত একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন, কিন্তু বিরোধী পক্ষ অবলম্বন করায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অর্জুন কর্তৃক নিহত হলে শাসনভার গ্রহণ করেন তার কন্যা পায়রামতি। এভাবে নরক এর বংশধরদের দ্বারা মৌর্য শাসনামল পেরিয়ে গুপ্ত শাসনামলের সূচনালগ্ণ ৩২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপ শাসিত হতে থাকে কখনও স্বাধীন কখনও বা করদ মিত্র রাজ্য হিসেবে। অতঃপর শুরু হয় বর্ম্মা বংশের রাজত্ব। অশোক স্তম্ভের শিলালিপি অনুযায়ী গুপ্ত শাসনামলের ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারতের খ্যাতনামা শাসক গুপ্ত কামরূপ অধিকার করেন। তৎকালে কামরূপ শাসন করতেন পুস্প বর্ম্মা নামে একজন শাসক। তিনি সমুদ্র গুপ্তের করদ মিত্র হন। এ বংশের শাসকদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন ভাস্কর বর্ম্মা। প্রখ্যাত চৈনিক বৌদ্দ পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে পুন্ড্রবর্ধনে এসেছিলেন। এ সময় ভাস্কর বর্ম্মা প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপের রাজা ছিলেন। ভাস্কর বর্মার রাজত্বকাল ৬০০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল বলে জানা যায়। ভাস্কর বর্ম্মার পর কামরূপে শালস্তম্ভ রাজবংশের রাজত্ব শুরু হয়। এ রাজবংশের সূচনা শুরু হয় শালস্তম্ভ নামে জনৈক রাজার মাধ্যমে। দশম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করার পর রাজা ত্যাগসিংহ এর শাসনের মধ্য দিয়ে এ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। শালস্তম্ভ রাজবংশের পরে কামরূপ রাজ্যের সিংহাসনে বসেন কামরূপ পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা ব্রহ্ম পাল। তিনি গৌড় ও মগধের পালদের অনুকরণে ‘কামরূপ পাল অধিপতি’ উপাধি ধারণ করেন। এ রাজবংশের শাসনামলে রাজ্যে অরাজকতা দেখা দিলে কামরূপ পালবংশীয় রাজা ধর্ম পাল (১০৯০-১১২৫ খ্রিষ্টাব্দ) বারেন্দ্রীয় পাল বংশীয় শাসক রাম পাল কর্তৃক উৎখাত হন। অতঃপর করদ মিত্র হিসেবে রাজত্ব করেন তিগ্মদেব, বৈদ্যদেব ও রাজা পৃথু। সমসাময়িককালে সামন্ত সেনের দ্বারা সেন রাজবংশের গোড়াপত্তন ঘটে এবং সমতটের চন্দ্রবংশীয় রাজা মানিকচন্দ্র এ অঞ্চলসহ কামরূপের বিশাল এলাকা দখল করেন। অতঃপর কান্তেশ্বর নামে একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি কোচবিহারের গোসানীমারীতে রাজধানী স্থাপন করে কামতা-বিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শাসন কার্যের সুবিধার্থে কামতা-বিহার রাজ্য ৪টি প্রদেশে বিভত্তু ছিল – কাম পীঠ, ভদ্র পীঠ, সৌমার পীঠ ও রতণ পীঠ। এ অঞ্চল শাসিত হতো রতণ পীঠের আওতায়। বর্তমান লালমনিরহাট জেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নে বিদ্যমান বৃদ্ধেশ্বরী মন্দিরটি রাজা কান্তেশ্বর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংসসহলে নির্মিত। রাজা কান্তেশ্বরের পর চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত কামরূপের শাসক হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন – সন্ধ্যা, রূপ, সিংহধ্বজ, প্রতাপধ্বজ, ধর্ম নারায়, দুর্লভ নারায়ণ ও ইন্দ্র নারায়ণ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কামতাধীপতি হিসেবে সেন বংশের গোড়াপত্তন ঘটে এবং কামরূপ অভিহিত হতে থাকে কামতাপুর নামে। আজকের লালমনিরহাটসহ রংপুর অঞ্চল শাসিত হতে থাকে কামতাপুরের অধীনে। সেন বংশীয় কামতাধীপতি হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন – নীলধ্বজ, চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর। রাজা নীলাম্বরের রাজত্বকাল ছিল ১৪৮০- ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নীলাম্বর তার রাজধানী কামতাপুর থেকে রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত অনেকগুলো রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে নীলাম্বরী সড়ক এবং দর্পার মাল্লি উল্লেখযোগ্য। সড়ক দু’টি কামতাপুর থেকে বর্তমান রংপুরের মধ্য দিয়ে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কোটেশ্বরে (বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার পাঙ্গা) একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যার ধ্বংসস্থলে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পাঙ্গেশ্বরী লক্ষ্মীপ্রিয়া নতুনভাবে মন্দির নির্মাণ করেন।

সেন শাসনামলের ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষণ সেনের সময় দিল্লীর প্রথম মুসলমান সম্রাট ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক। তার সম্মতিক্রমে দিগ্বিজয়ী তুর্কী বীর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী পশ্চিমবঙ্গ বিজয় করেন। অতঃপর নদীয়া জয় করে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষণাবতী (গৌড়) দখল করেন এবং রাজধানী স্থাপন করেন। নববিজিত রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি অধিকৃত এলাকাকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করেন যার একটি হচ্ছে – বারসৌল। বর্তমান দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকা বারসৌল বলে অভিহিত, যা প্রাচীন বরেন্দ্র ভূমির উত্তরাংশের (দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া) কেন্দ্রস্থল ছিল। ফলে এতদঞ্চলসহ বহু অঞ্চলে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে, বহু যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তার ঘটতে থাকে মুসলমানদের। এ সময় এতদঞ্চলের কোচ ও মেচ জাতির অনেক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যাই হোক, বখতিয়ার খিলজী তিব্বত অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে কামরূপ বিজয়ে অগ্রসর হন। কামরূপে তার বাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন এবং অল্পকাল পরে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে নিহত হন। বখতিয়ার খিলজীর অকাল মৃত্যুতে রংপুর অঞ্চল আবার কামরূপের শাসনাধীনে চলে যায়। এরপর ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী কামরূপের বিরুদ্ধে অভিযান করে ব্যর্থ হন। পরে ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অভিযান চালান সুলতান মুগীস উদ্দীন ইউজবেক উপাধীধারী ইখতিয়ার উদ্দীন ইউজবেক। প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করে তিনি কামরূপের রাজধানী পর্যন্ত অধিকার করেন, কিন্তু বর্ষা আরম্ভ হওয়ায় কামরূপ বাহিনীর আক্রমনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং আত্মসমর্পন করেন। বন্দি অবসহায় তার মৃত্যু ঘটে। পরবর্তী অভিযান প্রেরিত হয় সুলতান তুঘরিল খানের রাজত্বকালে ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। এ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার দীর্ঘ সময় পর রাজা চক্রধ্বজের শাসনামলে (১৪৬০-১৪৮০) কামতাপুরে অভিযান চালান সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের মুসলিম সেনাপতি রহমত খাঁ এবং তৎপরবর্তী সময়ে সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজীর নেতৃত্বে ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কামতাপুর বিজয় হয়। কিন্তু সুলতান বারবাক শাহের ঘোড়াঘাটের হিন্দু ফৌজদার ভান্দসী রায়ের চক্রান্তে সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজী প্রাণদন্ডে দন্ডিত হলে মুসলমানদের এ বিজয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অতঃপর সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ কামতাপুরে অভিযান চালিয়ে রাজা নীলাম্বরের প্রধানমন্ত্রী শচিপাত্রের সহায়তায় ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কামতাপুর দখল করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এতদঞ্চলসহ কামতাপুর রাজ্য গৌড়ের অধীনে ছিল। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ এর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ এর আমলে কোচ জাতি খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিশু নামক জনৈক কোচ সর্দার সমগ্র কামতা রাজ্য দখল করে এখানকার মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে কোচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা বিশু কোচ উপজাতীয় নাম পরিত্যাগ করে নিজ বংশকে রাজবংশী বলে অভিহিত করেন এবং মহারাজা বিশ্বসিংহ নাম ধারণ করে হিন্দু ধর্মকে রাজধর্ম বলে ঘোষণা করেন। বিশ্বসিংহের বংশধরেরা ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোচবিহার শাসন করেন। কোচবিহার মহারাজা বিশ্বসিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র নরসিংহ ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এ অঞ্চলে এসে পাঙ্গা জমিদারীর গোড়াপত্তন করেন। মোগল আক্রমনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান লালমনিরহাটসহ গোটা রংপুর অঞ্চল কোচবিহার রাজ্যের অংশ ছিল।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই বিহারে রাজমহলের যুদ্ধে সুলতান দাউদ খান মোগল সম্রাট আকবরের বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে বাংলায় মোগল শাসনের সুত্রপাত ঘটে। এ সময় কোচ রাজা নরনারায়ণের মাধ্যমে কোচবিহার রাজ্য মোগল সামাজ্যের করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয় এবং ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল। নরনারায়ণের মৃত্যুর পর লক্ষ্মীনারায়ণ ও রঘুদেবের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের কারণে লক্ষ্মীনারায়ণ মোগল শক্তির সাথে মিত্রতার বন্ধনকে আরও অটুট করতে মোগল সুবাদার মানসিংহের সাথে নিজ ভগ্ণী প্রভাদেবীর বিবাহ প্রদানের জন্য মানসিংহকে ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহারে আমন্ত্রন জানান। মানসিংহ বর্তমান লালমনিরহাট জেলার উপর দিয়ে কোচবিহার গমণকালে সাপ্টিবাড়ীতে একটি সেনানিবাস সহাপন করেন। ধারণা করা হয়, মোগলরা এ সময় থেকেই এতদঞ্চলকে কোচবিহার বা কামরূপ বিজয়ের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের সূচনা করেন। ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মানসিংহ দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন জাহাঙ্গীর। এদিকে মহারাজা লক্ষ্মীনারায়ণের সাথে মোগলদের সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি দিল্লীতে সম্রাটের সাথে যোগাযোগ করে সম্পর্কের উন্নতি ঘটান। তার মৃত্যুর পর কোচবিহারের পরবর্তী মহারাজাদের সাথে মোগলদের যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকে। ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনী পাঙ্গা আক্রমন করলে পাঙ্গাধীপতি মদুসূদন পরাজিত হন এবং মোগল বশ্যতা স্বীকার করেন। এ সময় পাঙ্গার দুর্গম জঙ্গল অতিক্রম করে পূর্ব ভাগ পরগনা দখল করা মোগলদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। অন্যদিকে ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দেই উপেনচৌকি তালুকদারীর মাধ্যমে পুরোহিত মুরারিদেব ঘোষাল তুষভান্ডারে একটি দেবোত্তর এস্টেট প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তার অধঃস্তন পুরুষ রামদেব ঘোষাল ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে কাযিরহাট এর দুই আনা অংশ ক্রয় করে তুষভান্ডার জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন।

কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ মোগল সম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং মোগল অধীকৃত কামরূপ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। এ সময় আসামের রাজা জয়ধ্বজ মোগল সাম্রাজ্যের বিরোধীতা শুরু করেন এবং কামরূপে মোগল বিরোধী অভিযান চালান। কামরূপের মোগল ফৌজদার লুৎফুল্লা তাদের মোকাবিলা করতে অসমর্থ হলে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে অহোম বাহিনী সমগ্র কামরুপ দখল করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করার পর তিনি কোচবিহার ও কামরূপে মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হন এবং ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর কোচবিহার অভিমুখে অভিযান চালান। মহারাজা প্রাণনারায়ণ ভয়ে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেলে মীর জুমলা ১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর কোচ রাজধানী অধিকার করেন, ফলে কোচবিহার পুনরায় মোগল সাম্রাজ্যভূক্ত হয়। ইসফান্দিয়ার নামক একজন সেনাধ্যক্ষকে কোচবিহারের অস্থায়ী ফৌজদার নিয়োগ করে মীর জুমলা ১৬৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারী আসাম অভিযানে যাত্রা শুরু করেন। অভিযানের সময় অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক অহোম প্রধান মোগলদের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন। অবশেষে অহোমরাজ জয়ধ্বজ সন্ধির প্রস্তাব করলে মীর জুমলা সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হন এবং ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি সন্ধির পর ঢাকা মুখে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন এবং ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ ইন্তেকাল করেন। এদিকে রাজ্যচ্যূত মহারাজা প্রাণনারায়ণ আদিবাসী প্রজাদের সহায়তায় মোগলদের খাদ্য সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলে ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী কোচবিহার হতে ইসফান্দিয়ার সরে পড়তে বাধ্য হন, ফলে কোচবিহার পুনরায় মহারাজা প্রাণনারায়ণের হস্তগত হয়। একই খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। তিনি ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নব নিযুক্ত সুবাদার কোচবিহার আক্রমন করবেন বলে জানতে পেরে মহারাজা প্রাণনারায়ণ ভয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সম্রাটকে নিয়মিত কর প্রদান করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর কোচবিহারের সিংহাসন নিয়ে গৃহ বিবাদ শুরু হয় এবং মোদ নারায়ণ সিংহাসন অধিকার করেন। মোদ নারায়ণ সম্রাটকে কর প্রদানে অঙ্গীকার করেন, কিন্তু কয়েক বছর পর কর প্রদানে গড়িমসি শুরু করলে সুবাদার শায়েস্তা খান ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র এবাদত খানের নেতৃত্বে কোচবিহারে অভিযান প্রেরণ করেন। এ অভিযানে মহারাজা মোদ নারায়ণ পরাজিত হন এবং ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার আবারও করদ মিত্র হিসেবে মোগল সাম্রাজ্যভূক্ত হলেও এ সময় কোচবিহারের তিনটি পরগনা ফতেহপুর, কাযিরহাট ও কাকিনা স্থায়ীভাবে বাংলা সুবাদারীর অন্তর্ভূক্ত হয়। কাকিনা অধিকারের পর এবাদত খান এখানে মোগলদের স্মরণে একটি হাট স্থাপন করেন, যার নাম মোগলহাট। উল্লেখ্য যে, ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী কোচবিহার মহারাজা কর্তৃক কাকিনার চাকলাদার নিযুক্ত হন। এবাদত খানের নেতৃত্বে কোচবিহার অভিযানকালে রঘুরামের (কোচবিহার রাজকর্মচারী রমানাথ মজুমদারের বংশধর) পুত্র রাম নারায়ণ এবং রাঘবেন্দ্র নারায়ণ মোগল পক্ষ অবলম্বন করায় রাম নারায়ণকে কাকিনা পরগনার চৌধুরী এবং রাঘবেন্দ্র নারায়ণকে ঘড়িয়ালডাঙ্গার চৌধুরী নিযুক্ত করা হয়। ফলে একদিকে কাকিনায় ইন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীর চাকলাদারীর পরিবর্তে রাম নারায়ণের জমিদারীর সূত্রপাত ঘটে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ঘড়িয়ালডাঙ্গা জমিদারী।

আইন-ই-আকবরীর বিবরণ অনুযায়ী তিন ধরণের প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে মোগল রংপুর গঠিত ছিল। প্রথমতঃ ঘোড়াঘাট সরকারের কিছু অংশ, যা পরগনা পাতিলাদহ, কুন্তি, স্বরূপপুর এবং রোকনপুর। দ্বিতীয়তঃ সরকার বাঙ্গালভূম, যা পরগনা ভিতরবন্দ ও বাহারবন্দ (ফুলবাড়ী ও রাজারহাট উপজেলা বাদে বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলা এবং গাইবান্ধা জেলা)। তৃতীয়তঃ রংপুর সদর যা সরকার কোচবিহার বা কাছওয়ারা নামে অভিহিত ছিল। এটি ৬টি পরগনা নিয়ে গঠিত ছিল – কাযিরহাট (বর্তমান নীলফামারী জেলা), কাকিনা (বর্তমান পাটগ্রাম উপজেলা বাদে লালমনিরহাট জেলার অধিকাংশ এলাকা), ফতেহপুর (বর্তমান কাউনিয়া, পীরগাছা, বামনডাঙ্গা, নলডাঙ্গা এলাকা), বোদা (বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলা), পাটগ্রাম (বর্তমান লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলা) এবং পূর্বভাগ (বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা এবং লালমনিরহাট সদর উপজেলার কিয়দাংশ)। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাটগ্রাম, বোদা এবং পূর্বভাগ পরগনা বাদে উল্লিখিত তিন ধরনের প্রশাসনিক এলাকা মোগলদের দখলে আসে। এসময় পূর্বভাগ পরগনায় কোচবিহার মহারাজার জমাদার ছিলেন জান মোহাম্মদ। পরে তিনি গোমস্তা হন এবং অবশেষে চৌধুরী হিসেবে নিযুক্ত হন। বাকী তিনটি পরগনা দখল করতে মোগলদের আরও ২৪ বছর অতিবাহিত হয়। ১৭১১ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার মহারাজা রুপনারায়ণের সময় বাকী তিনটি পরগনা চূড়ান্তভাবে মোগল সাম্রাজ্যভূক্ত হলে সন্ধির মাধ্যমে কর দানের স্বীকৃতিতে মোগলদের নিকট থেকে মহারাজা কর্তৃক তা ইজারা হিসেবে গৃহীত হয়।

ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, আজকের লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা একেক সময় একেক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা শাসিত হয়েছিল কখনও চাকলাদার-তালুকদার-গোমসতা-জমিদারগণের দ্বারা, কখনও বা চৌধুরী-জমিদার-জোতদারগণের দ্বারা। মোগল ও বৃটিশ আমলে স্থানীয় পর্যায়ে এ এলাকা শাসিত হয়েছিল চৌধুরী-জমিদার-জোতদারগণের দ্বারা। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন পাঙ্গা পরগনা, পূর্বভাগ পরগনা, কাকিনা পরগনা, তুষভান্ডার জমিদারী (উপেনচৌকি তালুক তথা দেবোত্তর এস্টেট ও কাযিরহাট পরগনার কিয়দাংশ) এবং পাটগ্রাম পরগনার অংশ নিয়েই মূলতঃ আজকের লালমনিরহাট জেলার ভৌগলিক সীমানা গঠিত। পরবর্তীতে বিবিধ কারণে এ জেলার বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার বিভিন্ন অংশ অন্যান্য পরগনার সাথে যুক্ত হয় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে অনেক পরগনার অধীনে শাসিত হতে থাকে।

ব্রিটিশ শাসনামল     

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট রবার্ট ক্লাইভ এর নেতৃত্বে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা বৃটিশ কর্তৃক দেওয়ানী লাভের পর শাসনকার্যের সুবিধার্থে ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর কালেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তা পুর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে। এসময় বর্তমান লালমনিরহাটসহ গোটা রংপুর অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন নূরউদ্দীন বাকের মোহাম্মদ জঙ্গ বাহাদুর, যিনি নূরলদীন নামেও পরিচিত। বিদ্রোহ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিদ্রোহীদের দমনের জন্য ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্ষিপ্রতার সাথে সেনা অভিযান চালানো হয় অতিপ্রত্যূষ থেকে। একদল সেনা কৃষকের বেশে বিদ্রোহী কৃষকদের পাটগ্রাম ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে যুদ্ধে ৬০ জন বিদ্রোহী কৃষক সেনা নিহত হন এবং আহত হন কয়েকশত। এদিকে রংপুরের তৎকালীন কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড এবং ইংরেজ সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ড এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের প্রধান ঘাঁটি মোগলহাটে আক্রমন চালানোর জন্য ইংরেজ সেনারা অগ্রসর হন। পথিমধ্যে সাপ্টিবাড়ী এলাকায় এক যুদ্ধে নূরলদীনের অন্যতম সঙ্গী লালমনি সহ অনেক যোদ্ধা বীরত্বের সাথে আপোষহীনভাবে যুদ্ধ করে নিহত হন। অনেকের মতে, কৃষক বিদ্রোহের বীর যোদ্ধা লালমনি এর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য পরবর্তীতে গণমানুষের মাধ্যমে এ এলাকার নামকরণ করা হয় লালমনিরহাট। যা হোক, মোগলহাটে বিদ্রোহী কৃষকদের সাথে ইংরেজ সেনাদের সংঘটিত যুদ্ধে নূরলদীনের অন্যতম সহচর দেওয়ান দয়ালশীল সহ অনেক বিদ্রোহী কৃষক সেনা নিহত হন এবং নূরলদীন গুরুতর আহত হলে তাকে দেহরক্ষীরা অতিগোপনে রংপুরের বর্তমান মিঠাপুকুর উপজেলাধীন ফুলচৌকি গ্রামে নিয়ে যান। কিছু দিন পর সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র বাংলায় ঘোড়াঘাটসহ মোট ৩৫টি কালেক্টরেট বা জেলার সৃষ্টি করা হয়। এক বছর পর ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জেলার সংখ্যা কমিয়ে ২৩টি করা হয়। এ সময় ঘোড়াঘাট জেলার বিলুপ্তি ঘটে এবং বর্তমান গাইবান্ধা অঞ্চল (ইন্দ্রাকপুর) চলে আসে রংপুর কালেক্টরেট এর অধীনে।

পরবর্তীতে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় কোম্পানি সরকার জেলাসমূহকে মহকুমায় বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সময় বৃহত্তর রংপুর জেলা বিভক্ত হয় ২টি মহকুমায় যথা – মাহিগঞ্জ (রংপুর) এবং ভবানীগঞ্জ। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ মাহিগঞ্জ এবং ভবানীগঞ্জ মহকুমার অধীনে বিদ্যমান থানাগুলো হচ্ছে-

  1. মাহিগঞ্জ মহকুমাঃ  মাহিগঞ্জ, নিসবেতগঞ্জ, দরওয়ানী, জলঢাকা, ডিমলা, ফুরুনবাড়ী, বড়বাড়ী, নাগেশ্বরী, আবেপুর, কয়েরগঞ্জ, মোলঙ্গা এবং পীরগঞ্জ থানা।
  2. ভবানীগঞ্জ মহকুমাঃ  ভবানীগঞ্জ, চিলমারী, সাদুল্ল্যাপুর এবং গোবিন্দগঞ্জ থানা।

শাসন কার্যের সুবিধার্থে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে অনেক থানা বাতিল করে নতুন থানা গঠন, অন্য স্থানে স্থানান্তর, পুনর্বিন্যাস এমনকি নতুন জেলাও গঠিত হয়েছিল। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘জলপাইগুড়ি’ নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করা হয়। এ সময় বোদা, ফকিরগঞ্জ ও সন্ন্যাসীকাটা থানার সাথে পাটগ্রাম থানাও জলপাইগুড়ি জেলাভূক্ত হয়, পরে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের কারণে পাটগ্রাম থানা পুনরায় রংপুরের সাথে সংযুক্ত হয়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে বড়বাড়ী থানা কুলাঘাটে এবং ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফুরুনবাড়ী থানা কালীগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় বড়বাড়ীতে মুন্সেফ আদালত ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। ৩৮.১৫ একর জমি হুকুম দখল করে লালমনিরহাটে রেলওয়ে জংশন নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। কুলাঘাটকে বাতিল করে লালমনিরহাটকে থানা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে লালমনিরহাট রেলওয়ে জংশন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে থানা হেডকোয়ার্টাস লালমনিরহাটে স্থানান্তরিত হয় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে। অতঃপর ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কালীগঞ্জ থানার অংশ নিয়ে হাতীবান্ধা থানা গঠিত হয়।

১৯৩১ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা এবং পাটগ্রাম থানা যেসব পরগনার অংশ নিয়ে গঠিত ছিল সেগুলোর নাম নিম্ণে প্রদত্ত হলো –

ক্রমিক

থানার নাম পরগনার নাম

গ্রামের সংখ্যা

লালমনিরহাট পাঙ্গা, কাকিনা, টেপা, বামনডাংগা, কাযিরহাট, উদাসী, ফতেহপুর, বাষট্রি, মমহনা, লাটচাপড়া

১৮২টি

কালীগঞ্জ কাযিরহাট, কাকিনা, টেপা, চাকলা কাকিনা, পাঙ্গা

১২২টি

হাতীবান্ধা কাযিরহাট, টেপা, কাকিনা

৬৩টি

পাটগ্রাম পাটগ্রাম, কাযিরহাট, টেপা

৭৬টি

প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ নিরিখে জানা যায়, ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে আজকের রংপুরকে ‘রঙ্গপুর’ বলে উল্লেখ করা হতো। ধীরে ধীরে ‘রঙ্গপুর পরিবর্তিত হয়ে ‘রংপুর’ বলে অভিহিত হতে থাকে। যা হোক, প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মাহিগঞ্জ ও ভবানীগঞ্জ মহকুমার থানাসমূহকে একত্রিত করে রংপুর জেলার অধীনে মোট ৪টি মহকুমার সৃষ্টি করা হয়। মহকুমা গুলো হচ্ছে – রংপুর সদর, ভবানীগঞ্জ, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম। পরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের কারণে ভবানীগঞ্জ মহকুমার সদর দপ্তর গাইবান্ধায় স্থানান্তর করা হয়। কুড়িগ্রাম মহকুমা হওয়ার পর কুলাঘাট থানা এ মহকুমার আওতায় পড়ে এবং মুন্সেফ আদালত বড়বাড়ী থেকে কুড়িগ্রামে স্থানান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে রেল লাইন স্থাপনের পূর্বে লালমনিরহাট ছিল কুলাঘাট থানার অধীনে একটি ইউনিয়ন। সে সময় লালমনিরহাট ইউনিয়নের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ইউনিয়ন বোর্ড ছিল। কুলাঘাট থানা লালমনিরহাটে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ইউনিয়ন বোর্ডের কার্যক্রম যথারীতি চলতে থাকে। এফ ডব্লিউ ফিনলে নামে জনৈক আমেরিকান মিশনারি দীর্ঘদিন লালমনিরহাট ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নিজ দেশে ফিরে গেলে শ্যামপ্রসাদ রায় নামে জনৈক ব্যক্তি চেয়ারম্যান হন। অতঃপর উপেন সিংহ নামে আরেকজন কিছু দিনের জন্য ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। উপেন সিংহ এর পরে মোজাহার আলী প্রামাণিক নামে জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় লালমনিরহাট ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পরও তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে লালমনিরহাট ইউনিয়ন বোর্ড টাউন কমিটিতে রূপান্তরিত হয়।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি সাপটানা, খোর্দ্দসাপটানা, খুটামারা ও খোঁচাবাড়ী মৌজার সমন্বয়ে ৭ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট লালমনিরহাট পৌরসভা গঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তৎকালীন সংসদ সদস্য রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ (ভোলা)। লালমনিরহাট পৌরসভা হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার কর্তৃক প্রথম প্রশাসক নিযুক্ত হন তৎকালীন সিও (উন্নয়ন), লালমনিরহাট জনাব আব্দুস শহীদ চৌধুরী। লালমনিরহাট পৌরসভার নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন একেএম আবদুস সোবহান, যিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ এপ্রিল থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জেলার অধীনে বিদ্যমান ৪টি মহকুমা হচ্ছে – রংপুর সদর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম। মহকুমা গুলোর অধীনে থানার সংখ্যা ছিল মোট ৩১টি। এ সময় পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ এবং লালমনিরহাট থানার অধীনে মোট ৪৪টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা ছিল।

 

 

মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঝটিকা সফরের এক পর্যায়ে লালমনিরহাট আসেন এবং লালমনিরহাট বাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দী ময়দানের জনসভায় লালমনিরহাটকে মহকুমায় উন্নীত করণের আশ্বাস প্রদান করেন। ফলস্বরূপ ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রংপুর জেলার ৪টি মহকুমা ভেঙ্গে ৫টি করা হয়। মহকুমা ৫টি হচ্ছে – রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট। রংপুর সদর মহকুমার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জ থানা এবং কুড়িগ্রাম মহকুমার লালমনিরহাট থানা নিয়ে ৪৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার সমন্বয়ে লালমনিরহাট মহকুমা গঠিত হয়।

বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অবঃ) ম. মজিদ-উল হক প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত তারিখ অনুযায়ী ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি লালমনিরহাট মহকুমার শুভ উদ্বোধন করেন, যা ছিল বাংলাদেশের ৭১তম মহকুমা। খোর্দ্দ সাপটানাস্থ ক্যাথলিক চার্চের সামনে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, লালমনিরহাট এর বর্তমান কার্যালয়ের স্থলে ছিল মহকুমা প্রশাসকের প্রথম কার্যালয়। লালমনিরহাট মহকুমার প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব লুৎফর রহমান চৌধুরী। এ সময় রংপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব ম. মাহে আলম এবং কুড়িগ্রামের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব মনজুরুল ইসলাম। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল কালীগঞ্জ থানার ৭৫ বর্গমাইল অংশ নিয়ে আদিতমারী থানা গঠিত হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অবলম্বনে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ থানা, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর আদিতমারী থানা, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল হাতীবান্ধা এবং পাটগ্রাম থানা উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ

এদিকে সারাদেশের মহকুমা গুলোকে জেলায় রূপান্তরের জন্য যে তালিকা প্রস্তুত করা হয় তা থেকে লালমনিরহাট মহকুমার নাম বাদ পড়লে লালমনিরহাটকে জেলায় উন্নীত করণের দাবীতে আবদুল কাদের ভাষানী, কমরেড শামসুল হক, আবুল হোসেন, প্রয়াত কমরেড চিত্তরঞ্জন দেব, আবদুল কুদ্দুছ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন ত্রুমশ ব্যাপকতা লাভ করলে রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ (ভোলা) এঁর নেতৃত্বে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট ঢাকাসহ লালমনিরহাট জেলা বাস্তবায়ন কমিটি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে লালমনিরহাটকে জেলায় উন্নীত করার দাবীনামা পেশ করেন। ফলস্বরূপ ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা (মন্ত্রী) ডঃ শাফিয়া খাতুন কর্তৃক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে লালমনিরহাট মহকুমা ‘জেলা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ লালমনিরহাট সদর থানা ‘উপজেলা’ হিসেবে ঘোষিত হয়। ফলে লালমনিরহাট জেলার অধীনে উপজেলার সংখ্যা দাড়ায় – ৫টি; পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী এবং লালমনিরহাট সদর। এসময় লালমনিরহাট সদর থানার ছিনাই, রাজারহাট এবং ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পাশ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার সাথে যুক্ত হলে নবগঠিত লালমনিরহাট জেলায় ইউনিয়নের সংখ্যা দাড়ায় ৪১টি এবং পৌরসভার সংখ্যা ১টি। তাছাড়া লালমনিরহাট সদর উপজেলার আয়তন দাড়ায় ১০৪ বর্গমাইল। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল পাটগ্রাম উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন হিসেবে পরিগনিত হয় এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট এখানে ইউনিয়ন পরিষদের শুভ উদ্বোধন ঘটে, ফলে লালমনিরহাট জেলায় ইউনিয়ন সংখ্যা দাড়ায় ৪২টি। ডায়াবেটিক সমিতি, লালমনিরহাট এর সাবেক কার্যালয়ের স্থলে ছিল জেলা প্রশাসকের প্রথম কার্যালয়। লালমনিরহাট জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব মনজুরুল ইসলাম এবং পুলিশ সুপার ছিলেন এ.এইচ.এম. নুরুদ্দিন খান। লালমনিরহাট ‘মহকুমা’ থেকে জেলায় উন্নীত হওয়ার সময় রংপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব মো: মোসাদ্দর আলী। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয় স্থানান্তরিত হয় বর্তমান মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের স্থলে। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবার তা স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান স্থানে চলে আসে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি বিদ্যমান জেলা প্রশাসক কার্যালয় তথা কালেক্টরেট ভবনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদ।

মতামত দিন

হামার লালমনিরহাট

লালমনিরহাট জেলা